আপডেট

x

হিরন্ময় আলোয় আজো অম্লান প্রয়াত অধ্যাপক একেএম হারুনুর রশীদ

রবিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২১ | ৯:৪৪ অপরাহ্ণ |

হিরন্ময় আলোয় আজো অম্লান প্রয়াত অধ্যাপক একেএম হারুনুর রশীদ
Spread the love

আজো মনে সেই ধরাজ কণ্ঠ “আবার শ্লোগান আবার যুদ্ধ, সুন্দরের জন্য স্বপ্নবাজ, সুন্দরের জন্য সাহসী যোদ্ধা, সুন্দর মনের মানুষ সৃজনে দক্ষ কারিগর , শিক্ষা গুরু প্রয়াত অধ্যাপক একেএম হারুনুর রশীদ হিরন্ময় দুত্যিতে আজো অম্লান সুন্দর মনের মাঝে। একজন নয় সংখ্যায় তারা অনেক শিক্ষাগুরুর সুন্দরের শিক্ষায় আজো তারা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় যোদ্ধা হিসেবে কাজ করছে।

সোমবার ৮ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব,শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক একেএম হারুনুর রশীদ এর ১৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১ লা জুন ১৯৪৩ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
অধ্যাপক একেএম হারুনুর রশীদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুরস্থ লায়ন ফিরোজুর রহমান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি বেতার কেন্দ্র- এর জন্য অবদান রাখেন । যুদ্ধকালীন সময়ে অধ্যাপক একেএম হারুনুর রশীদ রচিত ও সুর করা গান, কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের অণুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। একাধারে কবি,লেখক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, নাট্যাভিনেতা, নির্দেশক, শিশু সংগঠক হিসেবে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। আমৃত্যু তিনি দেশপ্রেমিক হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি মানুষকে ভালবেসে গেছেন।

webnewsdesign.com

একটি কবিতা লেখা হবে,কথা গুলো সুরে হবে গান, কণ্ঠে উচ্চারিত হয়ে ভরবে সকলের মনপ্রাণ.মঞ্চে নাটকে উদ্দীপ্ত বচনে মুগ্ধ হবে সবাই, মা মাটি মানুষ দেশপ্রেমের দীক্ষা দিতে কবিতা গান নাটকে । মনে লালিত অক্ষরগুলো অনবদ্য বুননে সাজাতেন তিনি দিনে রাতে। একহাতে বাঁশরী ও কলম, অন্য হাতে রণাস্ত্র,সময়ের সেই সাহসী সন্তান। একটি স্বাধীন দেশে ফুলের মতোই ফুটফুটে আগামীর শিশুরা বেড়ে উঠবে আদরে সোহাগে যথাযথ অধিকার পেয়ে , সুশিক্ষায় হবে দেশপ্রেমিক সুনাগরিক অনন্য মেধা প্রজ্ঞায় দক্ষতায় । সেই দায়িত্ব নিয়ে সুন্দরের জন্যই যিনি সারাজীবন যুদ্ধ করেছেন। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে ব্যতিক্রমী দ্যুতি ছড়িয়ে গেছেন গভীর আন্তরিকতায়। শিক্ষাঙ্গনে, মঞ্চে, মাঠে,ময়দানে রণাঙ্গনে স্বর্ণালী স্মৃতি যাঁর। বহুবিধ মেধার আলোকিত রশ্মি ছড়ানোর সেই হিরন্ময় ব্যক্তিত্ব ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক , লায়ন ফিরোজুর রহমান রেসিডেন্সিয়াল একাডেমির অধ্যক্ষ একেএম হারুনুর রশীদ স্যার। ৮ নভেম্বর ১৬ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্যারের প্রতি রইলো প্রগাঢ় শ্রদ্ধা।

আশির দশকে পরিচয় কৈশোরকাল থেকে যৌবন পর্যন্ত যাঁর সান্নিধ্য শিক্ষা আদর ভালবাসার ঋণে বন্দী শুধু আমি নই, আমার মতো অনেকে। যাঁর শূন্যতা আজো উপলব্ধি হয় নানা ক্ষেত্রে। মনের মধ্যে অব্যক্ত আর্তনাদ – স্যার এ সময়ে আপনার প্রয়োজন ছিল। একটি মুক্ত স্বাধীন দেশের জন্য কথামালার চারা রোপন করে ঝড় তুফানে ছায়া দিয়ে নানা পরিচর্চায় স্যার যে স্বপ্ন দেখতেন ,সেই স্বপ্ন পথে সফল যাত্রায় এগিয়েছে বাংলাদেশ, অথচ কবিতা গান নাটকের সংলাপে সেই স্যার নেই।

“ওজু করে মাগো দু রাকাত আজ নফল নামাজ পড়ো দুঃখিনী এই বাংলাকে মা প্রাণ ভরে দোয়া করো” এই গানটি শুনেছিলাম কৈশোরকালে। গান লিখে সুর করেছিলেন চোখের সামনেই। চোখে মুখে দেখেছি দেশপ্রেমের ঝিলিক। দেখেছি একজন গীতিকার ,সুরকার, গায়ককে খুব কাছে। নিজের জন্য দোয়া চাওয়ার মানুষের ভীরে সৃষ্টি কর্তার কাছে দেশের জন্য দোয়া চাওয়ার সেই মানুষটির কাছেই প্রথম পেয়েছি দেশপ্রেমের দীক্ষা। নিজ মাতৃভূমির প্রতি ব্যতিক্রমী ভালবাসা, নানা সুবিধা ত্যাগ করে আজীবন তিতাস পাড়ের এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষকে নিবিঢ়ভাবে ভালবাসতেন তিনি। সাধারণ মানুষের পক্ষে কবি সেই সময় লিখেছিলেন “হাছা কথা কইছে গাইয়েন কিছুই আমরার নাই, পেট্টা ভাইরা কয়জন আমরা দুইডা বেলা খাই? অন্যের দয়ায় মরি আমরা অন্যের দয়ায় বাঁচি,অন্যের রঙ্গে ডঙ্গে আমরা খেমটা নাচন নাচি।” দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কবি লিখেছেন “ঢেউ আইতাছে মোড়ল সাব বাঁচতে পারবেন না শক্তির জোরে বেশী দিন আর নাচতে পারবেন না।” শান্তির আহবান জানিয়ে সেই নাট্যকার লিখেছিলেন, আমরা যদি একেক জনে একক কথা কই, ঝগড়া বিবাদ কইরা যদি আলগা আলগা রই, আমাগোর দূর্বলতার সুযোগ অন্য নিব, মাইরা কাইট্টা আমরার বংশ বিনাশ কইরা দিব।” এমনই কথা মালায় তিনি ঐক্যের বন্ধন গড়েছিলেন।

১৯৮৯ সাল দুঃসময় তখন। মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা উপেক্ষিত,মহান মুক্তিযুদ্ধের হিরন্ময় শ্লোগান জয়বাংলা শ্লোগান উচ্চারণে নানা বাঁধা, সেন্সর-এ খড়গ। আমি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজে স্যারের ছাত্র। স্যার ঘোষণা দিলেন “আবার শ্লোগান আবার যুদ্ধ”। যুদ্ধ কিসের? সুন্দর না অসুন্দরের? সুরের না অসুরের? ঠিক না বেঠিকের ? স্যার বলছেন নির্বাক আমরা । পিন পতনের শব্দও নেই ,এমন নীরবতা । কার সহযাত্রী তোমরা? শুক্ল পক্ষের না কৃষ্ণ পক্ষের? সত্য না অসত্যের? স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি কলেজ পড়–য়া অর্ধশত সংস্কৃতি কর্মী।

স্যার বলছেনই, চোখে স্বপ্ন বুকে মমতা, নীতি আদর্শের রেশমী চাদর অঙ্গে জড়িয়ে যেতে হবে। গন্তব্য অনেক দূর, নতুন সময়ে উন্নয়নে। অদ্বৈতের তিতাস ছাড়িয়ে মানিকের পদ্মায় এবং মেঘনা থেকে বঙ্গোপসাগরে তারপর মহাসাগরে ভাসাতে হবে সত্যের ভেলা।কথা নেই কারো মুখে, আমরা শুনেই যাচ্ছি। স্যার বললেন, তিতাস আর মেঘনার অববাহিকায় খা সাহেব ওস্তাদ আলাউদ্দিন খা, বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত, ব্যারিস্টার এ রসুল , ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের জন্ম ধন্য উর্বর মাটিতে জন্ম তোমার, ভয় কি, আছে অতীতের সাহস। এগিয়ে যেতে হবে। রক্ত ভরা নদী আর রক্ত গালিচায় স্থাপিত দেশ। লাল সবুজের গর্বিত পতাকা মুক্ত আকাশে। সোনালী ধানের ক্ষেত, সবুজ থেকে আসা রূপালী পাটের সম্ভার।কুয়াশা ভেদ করে মিষ্টি রোদ, কাশ বনের নরম পরশ ,নবান্নের পিঠা পুলি, বাউলের একতারা, সরোদের ঝংকার সবই আছে । শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির এতিহ্যের গরিমার চাই সুন্দর আগামী। স্যার থামার আগেই সমস্বরে উচ্চারণ হলো বজ্র কণ্ঠে “জয়বাংলা”।

আবারো উচ্চারণ সবার “আবার শ্লোগান, আবার যুদ্ধ।” স্যারের লেখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর সেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা নিয়ে সেই সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজে মঞ্চস্থ হলো দুইদিন ব্যাপী নাটক “আবার শ্লোগান, আবার যুদ্ধ।” সেই নাটকের সহকারী পরিচালক অভিনেতা কুশীলব হিসেবে আজও নিজেকে সময়ের যোদ্ধা হিসেবে গর্ববোধ করি।নাট্যাঙ্গনে বর্তমানের শ্লথ গতিতে স্যারের শূন্যতা আজ অনুভব করি।

কলেজের সেই ক্যাম্পাস, সেই খোলা মাঠ সেই শ্রেনী কক্ষ চেয়ার টেবিল সবই আছে শুধু স্যার নেই। নেই এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। শুধু কলেজেই নয় কাউতলীর সৌধ হিরন্ময়, ফারুকী পার্কের স্মৃতি সৌধ, নিয়াজ মুহম্মদ স্টেডিয়ামের পিটি প্যারেড,ঘোষনা মঞ্চ, কখনো শিল্পকলা একাডেমীর খোলা মঞ্চ, তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের সবুজ চত্বর ,টাউন ক্লাবের মঞ্চ, শিল্প সাহিত্য চক্র, সুরস¤্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে স্যারের শূন্যতা। স্যার যে সব স্থানে চলায় ,বলায় ,গলায় , সুরে গানে কবিতায় , শরীর দুলিয়ে ,হাত নাড়িয়ে উচ্চ স্বরে বলতেন অসীম সাহসে মুক্তিযুদ্ধের কথা, দেশের কথা , জাগরণের কথা , এগিয়ে যাওয়ার কথা। সর্বত্রই স্যারের শূন্যতা।

দেশ-নদী , মাটি-মানুষ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, শিশুদের লাঠিম নাটাই ফুল প্রজাপতি ফড়িং নানা কথার শব্দের গাথুনী, অনবদ্য বুনন কবিতা গানে সুর আজো আমাদের মনে দোলা দেয়। স্মৃতির ক্যানভাসে আজো আঁকা স্যারের কবিতা আর গান , সাহসী সেই উচ্চারণ। হৃদয়ে ভেসে থাকা হাস্যোজ্জ্বল স্যারের মুখ। শুধু স্পর্শ পাই না।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক একে এম হারুনুর রশীদ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। অগণিত ভক্ত ছাত্রদের মনে তিনি হিরন্ময় তারা হয়ে আছেন। স্যার বলতেন দলাদলি নয়, চাই গলাগলি । রক্ত ঋন শোধে দেশ গড়ার যোদ্ধা হতে হবে । বিচ্ছিন্নতা নয় সংহতিতে গড়তে হবে ঐক্য, সন্ত্রাসে দুঃশাসনে ভীত সস্ত্রস্থ নয়, সত্য সুন্দর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই ধারায় এগিয়ে চলুক দেশ, এদেশের নতুন প্রজন্ম। প্রয়াত অধ্যাপক একেএম হারুনুর রশীদ স্যারের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্যারের অবদানের প্রতি জানাই প্রগাঢ় শ্রদ্ধা।

লেখক:
আল আমীন শাহীন
সম্পাদক নতুনমাত্রা, সাংবাদিক, সংস্কৃতি সেবক।

মন্তব্য করুন

Development by: webnewsdesign.com