আমার ছোট বেলা থেকে একটি অভ্যাস ছিল বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ বা তাফসির মাহফিলে যাওয়ার। এখন হয়তো কর্মের ব্যস্ততার কারণে তেমন যাওয়া হয় না। আলেম-ওলামাদের প্রতি শ্রদ্ধা সবসময়ই ছিল এবং আছে৷ আমার পরিবারও ধার্মিক ও আলেমদের কদর করেন। আমার বাবা একাধিক বার হজ্জ করেছেন। আমার দাদাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেখিনি কোন তাহাজ্জুদ নামাজ না পড়তে। উনার মুখে থাকতো সবসময় জিকির। এসব বিষয়ে পরে একদিন লিখবো।
ওয়াজ বা তাফসির মাহফিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভেতরে যেখানেই গিয়েছি, একজন সাদা দাড়িওয়ালা সুন্দর একজন মুরুব্বিকে স্টেজে দেখতে পেতাম। উনাকে দেখেছি সবসময় আলেম-ওলামাদের সম্মান জানাতে। ওয়াজ বা তাফসিরের মাঝে এতো বয়োজ্যেষ্ঠ হয়েও তিনি আল্লাহর নামে তাকবির দিতেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের দক্ষিণ পৈরতলা বাসস্ট্যান্ডে এলাকায় আমার বাড়ি৷ শহরে চলাচলের সময় এই সাদা দাড়িওয়ালা মুরুব্বিকে দেখলাম। কিন্তু উনার নাম আমি জানতাম না।
পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম এই মুরুব্বির নাম ‘ওয়ালি হোসেন’ ওরফে ‘ওয়ালি হোসেন মাস্টার’। তিনি শহরের সরকারপাড়ার বর্তমান বাসিন্দা। খোঁজ নিয়ে জানলাম, উনার পৈতৃক বাড়ি সদর উপজেলার রামরাইল ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে। পেশায় ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সর্বশেষ ২০১০ সালে তিনি রামরাইল ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে যান। তিনি বরাবরই ছিলেন ধার্মিক।
নিজ হাতে সন্তানদের মানুষ করেছেন। এক ছেলেকে বানিয়েছেন দুই ছেলেকে আইনজীবী, এক ছেলে ইতালিতে প্রবাসী, এক ছেলে একটি ছাত্র সংগঠনে মূল দায়িত্বে আছেন, এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন সে সহ আরও এক মেয়ে সুদূর লন্ডন প্রবাসে ও এক মেয়ে কানাডায় প্রবাসে আছেন। নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছে স্কুল। রামরাইল নীরেন্দ্রনাথ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনি আজীবন সদস্য। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ওয়ালি হোসেন পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে আছেন। সারাদিন আল্লাহতালার ইবাদত করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি।
গতবছর ২০২১সালের ২৮ মার্চে এই ধর্মপ্রাণ মানুষটির জীবনে আসে এক দূর্বিষহ দিন। ২৬ মার্চ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালানো হয়। ২৮ মার্চ ছিল হেফাজতে ইসলামের ডাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হরতাল। সে দিন সকালের প্রথম দিকেই হামলার করা হয় ওয়ালি হোসেনের বাড়িতে। বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয় কতিপয় ধর্মের নাম দিয়ে ব্যবসায়ীরা। হামলা করে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া হয় তার ঘরবাড়ি। হামলার শিকার হন তার বৃদ্ধা স্ত্রীও।
এই হামলার কারণ একটাই ছিল। তার এক ছেলে একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা। ছেলে ছাত্র সংগঠন করলে পিতা বুঝি এর দায়ভার নিতে হয়! তিনি ভেবে পাননি তার দোষটি কোথায় ছিল। যে বাড়িটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে বাড়ি তো হালাল ইনকামে ওয়ালি হোসেন গড়ে তুলেছিলেন। এই বাড়ি তো তার ছেলের গড়া নয়! কেন তার বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? সেই ঘরে তো অনেক ধর্মীয় কিতাবও ছিল। এর বিচার পাবেন কিনা তা তিনি এখনো জানেন না। শুধু ফরিয়াদ জানিয়েছেন আল্লাহর কাছে। বিভীষিকাময় সেই দিনে কথা এখনো ভুলতে পারেনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ওয়ালি হোসেন ও তার পরিবার।
Development by: webnewsdesign.com
মন্তব্য করুন