টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই ইস্যুতে আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

সোমবার, ০৬ মে ২০২৪ | ১০:১৮ অপরাহ্ণ |

টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই ইস্যুতে আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
Spread the love

ভারত সরকার টাঙ্গাইল শাড়িকে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) পণ্য হিসেবে দাবি করার পর থেকে এ নিয়ে চলছে তীব্র সমালোচনা। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশন’ (ডব্লিউআইপিও)-এর বিধিমালা মেনে একটা দেশ তাদের নির্দিষ্ট কোনও পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি দেয়। এই সনদ প্রাপ্তির জন্য ভারত আবেদন করেছিলো ২০২০ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। এখন টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ ফিরে পেতে হলে বাংলাদেশকে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। তাই সেদিকেই হাঁটছে বাংলাদেশ সরকার।

ভারতের জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস রেজিস্ট্রি থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগের পক্ষ থেকে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ১০ বছরের জন্য সনদ দেওয়া হয়। এর পরেই বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয় ডিপিডিটি-তে জার্নাল প্রকাশের মাধ্যমে টাঙ্গাইল শাড়িকে প্রাথমিকভাবে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও এই স্বীকৃতি পাওয়া মানেই সনদ পাওয়া না।

webnewsdesign.com

কোনও পণ্যের জিআই সনদ পেতে হলে কোনও একটা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে ডিপিডিটি বরাবর আবেদন করতে হয়। তাই, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি পেতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম ডিপিডিটি’র কাছে আবেদন করেছিলেন। তার আবেদনে সাড়া দিয়েই ডিপিডিটি টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। এই শাড়ির ইতিহাস, ঐতিহ্য, বুনন পদ্ধতি ও নিজস্বতা তুলে ধরে প্রকাশ করে জার্নাল নং ৩২।

জেলা প্রশাসকের করা আবেদনপত্রে বলা হয়েছে যে টাঙ্গাইল শাড়ি মূলত চার প্রকার এবং এখানে এই শাড়ির বৈশিষ্ট্যকে মোট ছয়টি ভাগে ভাগ ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো- টাঙ্গাইল শাড়ি সম্পূর্ণ হাতে বোনা হয়। তবে বর্তমানে মেশিন তাঁতেও বুনন করা হয়ে থাকে।

টাঙ্গাইল জেলা যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পাশে অবস্থিত হওয়ায় এখানকার জলবায়ু শাড়ি বোনার উপযোগী।
নদীর পানির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য সুতার প্রক্রিয়াজাতকরণ (যেমন- সুতা রঙ করা, মাড় দেওয়া) ভালো হয় এবং রঙের স্থায়িত্বের পাশাপাশি কাপড়ের স্থায়িত্ব ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায়।

শাড়ির পাড়ের নকশায় বৈচিত্র্য রয়েছে। পুরো বুননের পর পাড়ের ও জমিনের কিছু কিছু নকশা আলাদাভাবে হাতে বুনন করা হয়। আরামদায়ক একটি পরিধেয় বস্ত্র, যা যেকোনও ঋতুতে পরার উপযোগী।

টাঙ্গাইল শাড়ি মার্জিত, রুচিশীল ও আভিজাত্যপূর্ণ। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য ও শাড়ির বর্ণনা দেয়ার জন্য এই আবেদনপত্রে ঐ অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন প্রবাদও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ‘নদী চর খাল-বিল গজারির বন; টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’ বা, ‘চমচম, টমটম, তাঁতের শাড়ি; এই তিনে মিলে টাঙ্গাইলের বাড়ি’।

গবেষকদের মতে, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বাংলাদেশে। এর নামের মধ্য দিয়েই তা উঠে এসেছে। ইতিহাসও টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশের বলে সাক্ষী দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আশফাক হোসেন জানান, যেকোনো স্থানের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সেখানকার সাংস্কৃতিক ইতিহাস গড়ে ওঠে। টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসটিও তাই। বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় টাঙ্গাইলের ছেলেরা পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লুঙ্গি-গামছা। এ অঞ্চলের মেয়েরা পরিধান করে শাড়ি, যা টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়েছে। টাঙ্গাইল অঞ্চলটি যখন থেকে গড়ে ওঠে তখন থেকেই এ শাড়ি তৈরি শুরু হয়। এ শাড়ির নাম থেকেই এর উৎপত্তি বোঝা যায়।

তবে টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দাবি করে ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে করা এক পোস্টে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রঙ এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শাড়ি ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে দক্ষ কারুকার্যের নিদর্শন।

জিআই সনদ পেতে আইনি লড়াইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। সেই পথেই এখন হাঁটছে সরকার। বাংলাদেশের ডিপিডিটি’র পরিচালক আলেয়া খাতুন জানান, ভারতে টাঙ্গাইল নেই, আমাদের টাঙ্গাইল আছে। তাদের শাড়িটার ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই বলেছে যে বাংলাদেশের তাঁতিরা সেখানে গিয়ে শাড়ি বানায়। আর, তারা একটা হাইব্রিড শাড়িকে টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু হাইব্রিড কখনও জিআই হতে পারে না। জিআই হতে হলে একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে এটা উৎপাদিত হতে হবে। তার একটা ঐতিহাসিক পটভূমি থাকতে হবে। টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য আমাদের টাঙ্গাইল জেলাতেই আছে।

টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সত্ত্ব ফিরে পেতে শিল্পমন্ত্রণালয় ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানকে আইনি লড়াইয়ের জন্য নিয়োগ দিয়েছে। সোমবার (৬ মে) এই তথ্য জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারোওয়াত সিরাজ শুক্লা। তিনি বলেন, ভারতের ম্যাসন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশের টাকায় ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে লড়াই করবেন। ভারতের জিআই বাতিল করার জন্য তারা আবেদন করবেন।

মন্তব্য করুন

Development by: webnewsdesign.com