‘মা’ দিবস কেন? এইটাই আমার মটকায় ঢুকে না। স্রষ্টার পরের আসনটাই তো মায়ের। স্বয়ং স্রষ্টা বলে দিয়েছেন, ‘আমার পরে যদি তোমার কাউকে সেজদা করার থাকে তিনি হচ্ছেন তোমার মা, তোমার মা, এবং তোমার মা।’ এরচাইতে কঠিনতর সত্য এবং রূঢ় বাস্তবতা জগতে দ্বিতীয়টা নাই। গভীর ঘুমের মধ্যে খানিকটা চোট পেলেও আমরা ‘ওহ্ মাগো’ বলে চিৎকার করে ওঠি। আর এমনটা কী কেবল আমি-ই? না, সেটি মোটেই নয়। যিনি নিজেও মা এমনকি মায়েরও মা হয়েছেন, তিনিও এমনটিই করেন বৈ কি। ক্ষেত্রবিশেষে অনেকে হয়তো সৃষ্টিকর্তাকেও এতোবার ডাকেন না, যতোবার মাকে ডাকেন। তথাপিও কেবল একটি দিন ‘মা’ দিবস! বছরের আর বাদবাকি ৩৬৪ দিন তাহলে———————-!
—
আমার ‘মা’ অনেকটাই সেকেলের মানুষ। গৃহস্থ ঘরের মেয়ে-বউ। তিনি পড়াশোনার বালাই-ই জানেন না। তথাপিও আমায় পড়িয়েছেন তিনিই। ‘আমায় পড়িয়েছেন’ এই কথাটায় নিশ্চয়ই খটকা লাগছে, তাইনা? আর খটকা লাগাটাই তো স্বাভাবিক। বিষয়টি হচ্ছে, আমার বড় ভাই-বোনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে মাধ্যমিকের গণ্ডিটাও আমার পার হবার কথা নয়। কিন্তু আমার ‘মা’ আমাকে তেমনটি থাকতে দেননি। সংসারের কঠোর বেড়াজাল ডিঙিয়েও ‘মা’ আমাকে পড়াশোনা করবার মতো সুযোগটুকুন অন্তত করে দেন। তিনি এমনটি করে দিয়েছিলেন বলেই সেই অঁজপাড়াগাঁয়েই শিক্ষার মশাল জ্বালতে পেরেছিলাম এসএসসি পাশ করা তৃতীয়জন হিসেবে। এরপর থেকে কেবলই সামনে এগিয়ে চলা। আর সেসবের কৃতিত্বের দাবীদার আমার ‘মা’। তথাপিও আমার ‘মা’ লেখাপড়া জানা মানুষ নন, আর এসব সঙ্গতেই তিনি ফেসবুক চালাতেও জানেন না; জানবার কথাও না। তাহলে আমি এখানে অর্থাৎ ফেসবুকে মাকে উদ্দেশ্য করে ভালোবাসা-গভীর ভালোবাসা- শ্রদ্ধা-ভক্তি -সালাম-ভক্তিপূর্ণ সালাম-বিনম্র শ্রদ্ধা ইত্যাদি জানালে কি তিনি আদৌ বুঝতে পারবেন? তাহলে এটা কী ধরণের————— হবে?
—
কিছুদিন যাবৎ আমার ‘মা’ আমার কাছে নেই। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের অপর দুই ছেলে এবং প্রায় পার্শ্ববর্তী গ্রামে বসবাসরত ওনার মেয়েরা আবদার করে বসলেন, তাদের আবদার রক্ষার্থেই টানা দেড় যুগেরও অধিকটা সময় আমার সাথে অবস্থানকারী ‘মা’ অনেকটা বাধ্য হয়েই এখন থাকছেন গ্রামের বাড়িতে। অতএব, এ বিষয়টায় আমি নেহায়েতই উপায়হীন তাছাড়া ওটাতো ওনার স্বামীর ভিটে। সেই পাঁচ যুগেরও আগে পিত্রালয় ছেড়ে এ ভিটাতেই তিনি গেড়েছিলেন আবাস। আমরা ছয়-ছয়জন ভাইবোনকে জন্ম দিয়েছেন, লালন-পালন করেছেন। সেখানটায় থাকতে তিনিও বেশ স্বস্থিবোধ করেন। মা আমার থেকে দূরে আছেন ঠিকই, কিন্তু মোবাইল ফোনের বদৌলতে তেমনটা মনেই হয়না। ঘন্টা কয়েক কথা না বললে মা নিজেই যেনো বেচৈন হয়ে ওঠেন। আজকাল অবশ্য কাউকেই বলতেও হয়না, মোবাইলের কোনোকিছু না বুঝলেও আমায় অন্তত মিসডকল দিতে পারেন নিজে নিজেই।এইতো সেদিন, গভীররাত দেড়টার দিকে ঘুমুতে যাবার সময়ে হঠাৎ করেই মায়ের প্রসঙ্গটি ওঠে। আর মাকে নিয়ে আমাদের মাঝে কথোপকথন চলতে থাকে অন্তত এক ঘন্টা নাগাদ। কই? এইখানে তো মায়ের উপস্থিত থাকাটারও প্রয়োজন পড়েনি!
—
মাকে নিয়ে জগতের হাজার মানুষের হাজারো? ভাবনা থাকতেই পারে। আমার কাছেও আমার মাকে নিয়ে এক ধরণের ভাবনা বিদ্যমান। আমার ভাবনাকে আমি ধারণ-লালন করি, তদানুযায়ীই জীবনাচার করি বটে। আবার এটাও সত্য, আমরা ভাইবোন ছ’জনের মধ্যে মাকে আমারচে’ বেশি জ্বালাতন অপর কেউই করেনি, করেওনা। কিন্তু আমার মা আমায় কতোখানি ভালোবাসেন, তা আমার পক্ষে প্রকাশ করা নিতান্তই বেসম্ভব।
“যার দেহেতে হলো আমার জন্মের অস্তিত্ব শুরু
যার মাধ্যমে এলাম ধরায়, যে সবচে’ বড় গুরু।
যার আদর আর ভালোবাসাতে পূর্ণ এই জীবন
মোর কান্না হাসি স্বপ্ন সুখ আর স্বর্গও যার চরণ।
যার খুশিতেই থাকেন খুশি স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বানা
সে-ইতো আমার সাক্ষাত বেহেশত-সে আমার ‘মা’।”
উপরি উক্ত লাইন কয়টি আমারই রচিত। মাকে নিয়ে আমার ভাবনার বহি:প্রকাশ এই লাইন ক’টায়। এরচে’ ঢের বেশি লেখা মাকে নিয়ে জীবনে লিখেছি-পড়েছিও। কিন্তু এই লাইনগুলোর ন্যায় উন্নততর কোনোকিছুই মনে হয়না। ছয় চরণবিশিষ্ট এই কবিতাটির নাম দিয়েছি ‘মাতা-পুত্র’। শেষের লাইন দু’টোর জন্য পেশাগত এই জীবনে গুরুতূল্য অনেকের কাছ থেকে পেয়েছি-পাচ্ছি অপরিমেয় ভালোবাসা-আদর।
—
ছোট্ট একটি শব্দ ‘মা’। এই ‘মা’ শব্দটিই যখন এতোটাই আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে, তখন আলাদা করে ‘মা দিবস’ কেন! আমার মনে হয়, আলাদাভাবে এই ধরণের দিবস পালন করে মায়ের মত অসাধারণ মানুষটিকে খাটো-ই করা হয়। কারণ ‘মা’ সার্বক্ষণিক একটি শব্দ, সর্বোৎকৃষ্ট ভরসার জায়গা। ‘মা’ নির্দিষ্ট কোনো বিশেষ দিনের জন্য নয়। এই ‘মা’ দিবসটি নেহায়েত হয়তোবা তাদের জন্যেই মানায়, যাদের ‘মা’ থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে! নিজের বাড়িতে থাকলেও একসময়কার গোশালা বা রন্ধনশালা কিংবা বাড়ির পেছনের দিককার ভাঙা-পরিত্যক্ত ঘরটাতেই কোনোরকমে প্রাণটা টিকিয়ে আছেন বেঁচে-বর্তে ! তথাপিও মা অহর্নিশ কেবল নাড়িছেঁড়া ধন অর্থাৎ সন্তানের মঙ্গল কামনা করে-ই যাচ্ছেন। অপরদিকে তাঁরই সন্তানেরা? আধুনিকতার দোহাই দিয়ে তথাকথিত ‘সুখী পরিবার’ কনসেপ্ট অনুযায়ীই দিব্যি আয়েশী জীবনাচার করেই যাচ্ছেন! নেহায়েত কালেভদ্রে মা’র কথা মনে পড়ে! আর তাদের মতো লোকদেরকে মনে করিয়ে দিতেই হয়তোবা ‘মা’ দিবস চালু করা হয়েছে কী না এ বিষয়টি আমার কাছে অনেকটাই অপরিস্কার। তবে আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস মাকে সম্মান করার দিন। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতেই প্রতিবছর দিনটি পালিত হয়। বিভিন্ন দেশে বিশেষ দিনে মা দিবস পালনের রীতি দেখা যায়। সকল দেশে একই দিনে মা দিবস পালিত হয় না। আজকাল অনেক দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘মা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। দিনটি আমাদের সবার জীবনে মায়ের গুরুত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
—
সম্মানিত পাঠক বন্ধুরা, আমার মনের আবেগটুকুনই আমি এখানটায় প্রকাশ করলাম মাত্র। এসব কেবলই আমার নিজস্ব মতামত, ভাবনা। আমার নিজের আবেগ-অনুভূতি অন্য কারোর সাথে না-ও মিলতে পারে। আর এটাই স্বাভাবিকতা। ‘মা’ আসলে মা-ই। মায়ের কোনোই বিকল্প নাই। আমার হৃদয় কুরসীতে সদায়ই আমার মা আসীত আছেন। বহু বছর অবধি আমার মায়ের কোনো ছবিও ছিলো না আমার কাছে। আর বর্তমানে, উন্নত সভ্যতা তথা ডিজিটালাইজড’র কল্যাণে মা’র অবয়ব (ফটোগ্রাফ) অহর্নিশ আমার সাথেই থাকে। আমি সদায় নিজেকে মাতৃধনে ধনী বলেই মনে করি। তথাপিও আজ (মে মাসের দ্বিতীয় রোববার) যেহেতু ‘মা দিবস’ (স্রেফই কাগুজে), সেহেতু জগতের সকল মায়ের প্রতি রইলো আমার অনি:শেষ ভক্তি আর শুভ কামনা।
লেখক-
কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু
গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : serajhm@gmail.com
Development by: webnewsdesign.com
মন্তব্য করুন