দৌলতপুর’ নামে পরিচিত। যেই ঘরে নজরুল-নার্গিসের বাসর সাজানো হয়েছিলো, সেটির সামনে স্থাপিত হয়েছে স্মৃতিফলক। পার্শ্ববর্তী আরেকটি ঘরে আজও স্মৃতি করে রাখা কবি নজরুল-নার্গিসের বাসর’র জন্য সাজানো ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই পালঙ্ক। নার্গিসদের বাড়ির দক্ষিণের পুকুরপাড়ের আম্রতলায় বসেই একদা কবি রচেছিলেন তাঁর বিখ্যাত একখানি কবিতা। সেই আম্রতলার অবয়ব ন্যায় একটি বেদি এবং পাশেই স্থাপিত ‘পাপড়ি খোলা’ স্মৃতিফলক কবি নজরুলের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। এর খানিক দক্ষিণের মাঠে নজরুল মঞ্চ। এসব মিলিয়ে দৌলতপুর যেনো কবি নজরুলেরই গ্রাম। আর এজন্যই গ্রামটি ‘কবিতীর্থ দৌলতপুর’ নামে সমধিক পরিচিত।
—
কবি নজরুল ইসলাম একবার আইনসভার প্রার্থী হয়ে ভোট চাইতে হাজির হয়েছিলেন এক মৌলভির বাড়িতে। কবিকে দেখে আঁতকে উঠেন মৌলভি। ‘এ কি! আপনি তো কাফের! একজন কাফেরকে তো ভোট দেয়া যায় না!’ মৌলভির কথায় সায় দিলেন তার সাথীরাও। কিন্তু এমন আচরণেও কবি শান্ত ও স্থির গলায় বললেন, ‘মৌলভি সাহেব! কাফের বলেছেন তাতে দু:খ নেই। এর চেয়েও কঠিন কথা আমি শুনেছি।শুনতে হয়েছে অনেক জঘন্য কথাবার্তাও। তবে আপনার বাড়ি যখন এসেছি, আপনায় একটি কবিতা না শুনিয়ে চলে যাই কিভাবে?’ নজরুল তাঁর আবৃত্তির ডালা খুলে বসে শোনালেন তাঁর বিখ্যাত ‘মহররম’ কবিতা। কবির ভরাট গলার উচ্চারণে তৈরি হয় এক অপার্থিব আবেগ ও হৃদয়ছোঁয়া বেদনার পরিবেশ। এবার নত হয়ে এলো মৌলভি তমিজুদ্দীন এবং তার সাথীদের মাথা। এই কি নজরুল! কি অপূর্ব তার কবিতা। কত গভীরে এর বেদনা! আহা! এমন করে তো আর কেউ কবিতা শোনায়নি। মৌলভি সাহেব এবং তার সাথীরা অনুতপ্ত হয়ে পরম আদর-যত্নে বরণ করে নিলেন কবিকে।
একদা এক হিন্দু বন্ধুর আমন্ত্রণে তার বিয়ের আসরে হাজির হলেন কবি নজরুল। কবিসহ বরযাত্রীদের সবাই আহারের অপেক্ষায়, কিন্তু খাবার আসছে না। ভেতর থেকে প্রশ্ন এসেছে, বরপক্ষের সাথে একজন মুসলমান এসেছে কেন? অন্দরমহলের মেয়েরা খাবার পরিবেশন করবে না! মুসলমানকে বিদায় করতে হবে। নজরুলকে সাথে নিয়ে যাওয়া বন্ধুরা লজ্জায় লাল। অভিমানী নজরুল হিন্দুদের এমন সংকীর্ণ আচরণ আর জাতের কদর্য রূপ দেখে ব্যথিত হলেন, বেশ কষ্ট পেলেন। মনের ক্ষোভ নিয়ে একটি কবিতা লিখে সবাইকে শুনিয়ে দিলেন। কবিতার সূচনা অংশ, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছে জুয়া/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া?’ মুসলমান কবি নজরুলের মুখে এমন অগ্নিজ্বালা প্রতিবাদ শুনে নীচু হয়ে এলো সবার মাথা। অভিমানী নজরুল তাঁর কবিতা শুনিয়ে মলিন মুখে পা বাড়ালেন,সেই বিয়েবাড়ি থেকে চলে এলেন।
—
❝ কেউ বলেন আমার বাণী যবন,
কেউ বলেন কাফের’র।
আমি ও দু’টোর কোনটাই না,
আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে
এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যাণ্ডশেক করিয়ে
গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার
চেষ্টা করেছি মাত্র। ❞
-এই লেখায় তিনি আসলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন? তিনি কী সাম্প্রদায়িক নাকি সমাজের আর দশজনের চাইতেও অনেক গুণ বেশিই অসাম্প্রদায়িক? তথাপিও কাজী নজরুলে প্রতি আমাদের মনের দৈন্যতা যেনো আজও গেলোই না!
❝ গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ,
অভেদ ধর্মজাতি
সব দেশে সব কালে,
ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। ❞
সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের প্রাণান্তকর সংগ্রাম, সাম্য ও মুক্তির বাণী বর্তমান প্রেক্ষাপটে আরো অনেক বেশিই প্রাসঙ্গিক। পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতির প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন এবং নিজের প্রতি অনেকটা ধিক্কার জানিয়ে শুধু দু’টো লাইন উচ্চারিত করতে চাই, যদিও আমি নই কবি।
‘আমার একবুক কষ্ট এই ব্যাটাকে নিয়ে
তাঁর সবই নিলাম তাঁকেই কিছু না দিয়ে!’
——ক্ষমা করিও মোদের ভুল, জয়তু নজরুল।
লেখক:
কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী।
নির্বাহী সম্পাদক-দৈনিক প্রজাবন্ধু।
গ্রন্থাগার সম্পাদক-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : serajhm@gmail.com
Development by: webnewsdesign.com
মন্তব্য করুন